বিভীষণ কে? বিভীষণ কেন ঘরের শত্রু?
বাংলা ভাষায় আদিকাল থেকেই অনেক প্রবাদ-বাগধারা লোকমুখে ও সাহিত্যে প্রচলিত আছে। এই রকমই একটি বহুল প্রচলিত বাগধারা হল ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’। এর অর্থ, — স্বজন শত্রু, যিনি নিজের আপনজনের ক্ষতি করে, স্বজনবিনাশী, গোপনে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে স্বজনের ক্ষতিসাধনকারী।
আত্মীয়-স্বজন বা কাছের মানুষের কাছ থেকে কোনো ঝামেলায় পড়লেই চট করে আমরা স্মরণ করি বিভীষণকে। এখন প্রশ্ন হলো, কে এই বিভীষণ? কেনই বা তিনি সবার ঘরের শত্রু বনে গেলেন? কী-ই বা করেছিলেন তিনি?
এই বাগধারাটি বাংলায় এসেছে হিন্দু পুরাণ “রামায়ণ” থেকে। হিন্দু পুরাণ রামায়ণের একটি চরিত্র বিভীষণ(Vibhishana)। বিভীষণ(Vibhishana) ছিলেন বিশ্রবা মুনি ও কৈকেশী-র সন্তান এবং রাক্ষসরাজ রাবণের ছোট ভাই। বিশ্রবা মুনি ও কৈকেশী-র তিন ছেলে হলেন রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ। তাদের একটি ছোট বোনও ছিল, নাম তার শূর্পনখা।
“কুম্ভকর্ণ কে ? বিষ্ণুদেবের পরম ভক্ত থেকে রাবণ ও কুম্ভকর্ণ কী করে রামের শত্রু হলেন! এ নিয়ে আমাদের আগের লেখাটি পরতে পারেন।”
কাহিনীতে ফেরা যাক, তাদের মা কৈকেশী ছিলেন সুমালী রাক্ষসের মেয়ে। কৈকেশীর আরেক নাম নিকষা। সুমালী নিজে তার মেয়ে কৈকেশীকে বিশ্রবা মুনির কাছে পাঠিয়েছিল। কারণটি অবশ্য তেমন মহৎ কিছু ছিল না । এখন একটু পেছনের দিকের কাহিনীতে যাওয়া যাক…
সুমালীরা ছিল তিন ভাই। মাল্যবান, সুমালী ও মালী। তিনজন মিলে একবার সুমেরু পর্বতে কঠোর তপস্যা শুরু করে দেয়। তাদের সে তপস্যায় সন্তুষ্ট হন ব্রক্ষ্মা। খুশি হয়ে তিনি তিন ভাইকে তিনটি বর দেন- তারা হবে অজেয়, শত্রুহন্তা ও চিরজীবী।
বর পাওয়ার খুশিতে তারা সমস্ত জগত জুড়ে মারাত্মক উৎপাত শুরু করে। ধীরে ধীরে তাদের উপর বিরক্ত হয়ে ওঠে জনপদের প্রায় সবাই। শেষে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতা আর ঋষিরা মিলে বিষ্ণুর কাছে গিয়ে এর প্রতিকার চান। বিষ্ণু তখন তিন ভাইকে দমন করতে এগিয়ে আসেন। বিষ্ণুর হাতে মৃত্যু হয় মালীর। মাল্যবান আর সুমালী তাদের গোটা দলবল আর আত্মীয়-স্বজন নিয়ে পাড়ি জমায় পাতালপুরীতে। এরই মধ্যে তারা বিশ্বকর্মাকে দিয়ে ত্রিকূট পর্বতে লঙ্কাপুরী নির্মাণ করিয়ে নিয়েছিলো। তারা চলে গেলে বিশ্রবা মুনির পরামর্শে কুবের সেখানে বসতি স্থাপন করে। কুবেরও ছিলেন বিশ্রবা মুনির আরেক ছেলে। ব্রক্ষ্মার বরে তিনি ধন-সম্পদে ফুলে-ফেঁপে ওঠেন। তার হাতে লঙ্কাপুরী ভীষণ জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এ ঘটনার অনেক দিন পরে, সুমেলী পাতাল থেকে মর্ত্যলোকে আসে ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে সে আসেন লঙ্কাপুরীতে। সেখানে গিয়ে কুবেরের ঐশ্বর্য আর লঙ্কাপুরীর জাঁকজমকপূর্ণ চেহারা দেখে রীতিমতো চোখ কপালে উঠে যায় তার। ঈর্ষায় জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছিল সুমালী। যে করেই হোক, আবার লঙ্কাপুরীর দখল তাকে পেতেই হবে- সেই ভাবনা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে তার। সাথে প্রতিশোধের ব্যাপারটা তো আছেই। তখনই তার মাথায় আসে আরেক ফন্দি- বিশ্রবা মুনির সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কুবেরের মতো ধনকুবের আর ক্ষমতাধর সন্তানও পাওয়া যাবে, আবার হাতছাড়া হয়ে যাওয়া লঙ্কাপুরীও ফের দখলে আনা যাবে।
সেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে তার মেয়ে কৈকেশী বা নিকষাকে সে পাঠিয়ে দেয় বিশ্রবা মুনির কাছে। বিশ্রবা মুনি তখন তপোবনে তপস্যা করছিলেন। কৈকেশী তার কাছে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। মাথা নিচু করে মাটিতে আঙুল দিয়ে এলোমেলো দাগ টানতে লাগল সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনোযোগে বিঘ্ন ঘটল বিশ্রবা মুনির। চোখ খুলতেই তিনি দেখতে পেলেন কৈকেশীকে। তপস্যা থামিয়ে তাকে তপোবনে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। কৈকেশী তার পরিচয় বিশ্রবা মুনিকে বললেও এখানে আসার কারণ জানাল না। উল্টো তার প্রতি একধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলল, পারলে যেন সে তপোবলে সেই কারণ জেনে নেয়। তৎক্ষণাৎ আবার ধ্যানে বসে যান বিশ্রবা মুনি। দিব্য চোখে দেখতে পেলেন কৈকসী তার সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক স্থাপন করতে পাতালপুরী থেকে মর্ত্যে চলে এসেছে। তবে তার উদ্দেশ্য খুব একটা ভালো কিছু নয়। কিন্তু তারপরও কৈকসীর এত কষ্ট করে এতদূর এসেছে ভেবে কৈকসীর বাসনা তিনি পূরণ করলেন।
কিন্তু তার আগেই জানিয়ে দিলেন, এমনিতে কৈকেশী সকাল সকাল এসেছে, তার উপর মুনির ধ্যানও ভাঙিয়েছে। তাছাড়া তার নিয়তেও যথেষ্ট গোলমাল আছে। কাজেই তাদের সন্তানরা হবে রাক্ষস। খুবই খারাপ স্বভাবের রাক্ষস। তখন কৈকসী অনেক অনুনয়-বিনয় করে বিশ্রবা মুনির মন গলানোর চেষ্টা করে। শত হোক মা তো, নিজের সন্তানরা খারাপ স্বভাবের রাক্ষস হবে, এ কথা সে কীভাবে সহ্য করবে?
শেষমেশ খানিকটা নরম হয়ে অভিশাপ কিছুটা কমিয়ে দেন বিশ্রবা মুনি। জানান, কৈকসীর ছোট ছেলে রাক্ষস হলেও ভালো স্বভাবের রাক্ষস হবে, ভীষণ ধার্মিক হবে। কৈকসীর এই ধার্মিক রাক্ষস ছোট ছেলেটির নামই বিভীষণ।
এর অনেক দিন পরের কথা। রাম, লক্ষ্মণ, সীতা তখন বনবাসে ছিলেন। রাবণও বোনজামাই বিদ্যুজ্জিহ্বকে মেরে ফেলার পর তার বোন শূর্পণখাকে সেই বনেই থাকতে দিয়েছিল। সেখানেই রামের দেখা পায় শূর্পণখা। রামের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে সোজা গিয়ে তাকে প্রেম নিবেদন করে বসে শূর্পণখা। খালি রামই না, লক্ষ্মণও তাকে ফিরিয়ে দেয়। রেগে-মেগে শূর্পণখা গিয়ে সীতাকে খেয়ে ফেলতে উদ্যত হয়। তখন রামের আদেশে লক্ষ্মণ গিয়ে শূর্পণখার নাক কেটে ফেলে। সেই নাক কাটার বদলা নিতে রাবণ সীতাকে তুলে নিয়ে যায়।
আর এই ঘটনা থেকেই রাম-রাবণের যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। রাবণের এই সীতাকে তুলে নিয়ে আসার ব্যাপারটি মোটেও সমর্থন করেনি তার ছোট ভাই বিভীষণ। বিভীষণ ছিলো রামের ভক্ত। সে বারংবার বুঝিয়ে-শুনিয়ে সীতাকে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু রাবণ তার কথা তো শোনেইনি, উল্টো বিভীষণ যতবার এই প্রসঙ্গে কথা বলতে এসেছে ততবার তাকে ভর্ৎসনা করেছে।
সীতাহরণ মেনে নিতে পারেনি রাবণের আরেক ভাই কুম্ভকর্ণও। তবে শেষ পর্যন্ত কুম্ভকর্ণের কাছে তার পরিবারই বড় হয়ে ওঠে। আর তাই সে রাবণের কাজকে সমর্থন না করলেও তার পক্ষ নিয়ে রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। বিভীষণ কিন্তু তা করেনি। সে তার পরিবারকে ত্যাগ করে হলেও রামের পক্ষে যোগ দেয়। রাক্ষস-রাজ্যের নানা গোপন কথা, গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে রামকে যুদ্ধে জয়ী হতে সহায়তা করে। রাম রাবন এর যুদ্ধে বিভীষণ এর পুত্র তরণী সেন – ও রামের হাতে নিহত হন। যদিও এর জন্য বিভীষণ নিজেই দায়ী। বিভীষণ এর পুত্র/ছেলে তরণী সেন ও ছিলেন রামের ভক্ত। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে বিভীষণ তরণীর আসল পরিচয় রাম-এর কাছে গোপন করেছিলেন ৷ এভাবে রামের পক্ষ নিয়ে বিভীষণ হয়তো ন্যায়ের পক্ষে থেকেছে, ধর্মের পক্ষ নিয়েছে। কিন্তু আপন পরিবারের সাথে শত্রুর মতো আচরণ করে সে পেয়েছে বিশ্বাসঘাতকের পদবী। তারই ফলশ্রুতিতে আপন পরিবারের কেউ শত্রুর মতো আচরণ করলে বা নিজেদের পক্ষের কেউ বিরোধী পক্ষের হয়ে কাজ করলে তাকে বলা হয় ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’।