বাড়ি থেকে পালিয়ে – ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা
বাড়ি থেকে পালিয়ে শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প অবলম্বনে ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় অসাধারণ এক সিনেমা।
বাড়ি থেকে পালিয়ে এর গল্পটি মূলত এক অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ছেলেকে নিয়ে। সিনেমায় যার নাম কাঞ্চন। সে মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়ে বেড়াতে চায়,নতুন কিছুর প্রতি তার আগ্রহ চরমে। সে ঘরে বসে থাকার পাত্র নয়,অ্যাডভেঞ্চার তাকে আকর্ষণ করে….
কিন্তু, কাঞ্চনের বাবা রাশভারী প্রকৃতির মানুষ। কাঞ্চন তার বাবাকে জমের মতো ভয় পায়। কারণ, এক আধটু ভুল হলেই যে বাবা শাস্তি দেন। মা নতুন কিছু কিনলেই বাবা রাগ করেন তিনি বলেন এগুলো সব বিলাসিতা। মা তাকে অনেক আদর করে।তার লুকিয়ে বইয়ের ফাঁকে গল্পের বই পড়াও মেনে নেয় মা। কাঞ্চন বাবাকে যেমন জমের মতো ভয় পায় তেমনি মা কে খুব ভালোবাসে।
বাবার শাসনের ভয়ে একদিন পালিয়ে কলকাতা চলে আসে কাঞ্চন। প্রথমে উঁচু দালানকোটা, ব্রিজ, পাঁকা সড়ক,অনেক মানুষ সবাই অপরিচিত এদের ভীরে কিছুটা ভড়কে যায় কাঞ্চন। ভড়কে গেলেও নিজেকে সামলে নেয় কাঞ্চন।
অপরিচিত ইট কাঠের শহরে তার পরিচয় হয় ভাজাওয়ালা হরিদাস, ম্যাজিশিয়ান, পরিচারিকা মা, কনক নামে এক বালিকা এবং তার পরিবার, বোবা সাজা ছেলে, চোর এবং আরো অনেক নিন্ম-আয়ের জীবণ যুদ্ধে লিপ্ত মানুষদের সাথে। তাদের সাথে পরিচয়ের একপর্যায়ে কাঞ্চন যানতে পারে তাদের প্রায় সকলেই দেশভাগের ফলে ভিটেমাটি আর আত্নীয়স্বজন হারিয়ে পরিচয়হীন উদ্বাস্তু। একদিকে গগনচুম্বী দালানকোটা, ব্রিজ অন্যদিকে উদ্বাস্তুদের মিছিল, একদিকে অনিয়ন্ত্রিত পান-ভোজন অন্যদিকে খাবার নিয়ে কুকুর মানুষের লড়াই। কাঞ্চনের ধারণা ছিল-কলকাতা শহর এল ডোরাডোর মতো। সেখানে কেবল সুখ আর সুখ। বড় বড় ভবন যেমন আকাশচুম্বী, সেরকম সুখ। আমরা যেমন শুনি ঢাকার আকাশে টাকা ওড়ে, ঠিক সেরকম কাঞ্চনের ধারণা ছিল কলকাতায় টাকা ভেসে বেড়ায় আকাশে। কিন্তু তাই কি? এসব রুঢ় বাস্তবতা কিশোর কাঞ্চনের মনে দাগ কাটে অবিরত। হয় নতুন অভিজ্ঞতা…
আস্তে আস্তে ভেতরে বাড়ি ফেরার তাগিদ অনুভব করতে থাকে কাঞ্চন। মা-বাবার জন্য মন কাঁদতে থাকে কাঞ্চনের। এদিকে ছেলের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন কাঞ্চনের মা। রাশভারী বাবাও কাঞ্চনের খোজের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। বাস্তব আর কল্পনার কত ফারাক- ছোট্ট কাঞ্চন মাত্র ক’দিনে বুঝে গিয়েছিল। অনুধাবন করেছিল বাবা-মায়ের আদর, নাড়ির টান কী, যাদের বাবা-মা নেই তারা কত অসহায়। নিজের গ্রামে সে দু’মুঠো ভাত তো পেত। কিন্তু এই কলকাতা শহরে সে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।
হরিদাস ভাজিওয়ালা বাড়িতে বুঝিয়ে বাড়ি ফেরত পাঠান কাঞ্চনকে। সাথে দিয়ে দেন সেই দাড়ি আর ঝোলা ব্যাগ – যা পড়ে হরিদাস ভাজিওয়ালা। অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে কাঞ্চন ও পা বাড়ায় বাড়ির পথে।
ঋত্বিক ঘটক বাংলা চলচিত্রে এক আক্ষেপের নাম। ঋত্বিক নামের সূর্যটা যে খুব দ্রুতই অস্তনমিত হয়েছে।
ঋত্বিক ঘটক কোন প্রাপ্তির জন্য সিনেমা করেন নি। তিনি সিনেমার মাধ্যমে কিছু বার্তা পৌছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সবার মধ্যে। ঋত্বিক ঘটকের প্রায় সব ছবিতেই দেশভাগের দৃশ্যগুলো,হতাশা,ক্ষোভ উঠে এসেছে। এই ছবিতেও কিছুক্ষেত্রে উঠে এসেছে দেশভাগের হতাশা গ্রস্থ, ক্ষোভে ফেটে পড়া মানুষের আর্তচিৎকার….
দেশভাগ ঋত্বিক ঘটককে মনঃস্তাত্বিক ভাবে অনেক আঘাত দিয়েছিলো। তিনিও দেশভাগের ফলে হারিয়েছিলেন পরিজন চেনা পরিবেশ। দেশভাগের সময় তার বাবা তাদের নিয়ে ঢাকার জিন্দাবাজার থেকে কলকাতা চলে যান।তাই পরবর্তীতে তার সিনেমাগুলিতে দেশবিভাগ একটি উল্লেখযোগ্য জায়গা নিয়েছিলো সবসময়।
ঋত্বিক ঘটকের সবসময় উদ্দেশ্য ছিলো শুধু নিখাদ শিল্প তৈরী নয়। তিনি সমাজকে সচেতন করার জন্য হাতিয়ার হিসেবে সিনেমা কেই বেছে নিয়েছিলেন।”