রয়্যাল এনফিল্ড – কেন এতো জনপ্রিয়?
বিশ্বখ্যাত মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড রয়্যাল এনফিল্ডের নাম শোনেননি এমন মানুষ হয়তো খুব কমই আছেন। এটি এমন এক ব্র্যান্ড যা মোটরসাইকেল প্রেমীদের কাছে তো বটেই, ছড়িয়ে গেছে পুরো পৃথিবীতেই। এই অভিজ্ঞ মোটরসাইকেল প্রতিষ্ঠান এখনও তৈরি করে যাচ্ছে নতুন নতুন মোটরবাইক। কাল্ট ক্ল্যাসিক ঘরাণার মোটরসাইকেল ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে সবথেকে বেশি বিক্রি হয় রয়্যাল এনফিল্ডের মোটরবাইক। ক্ল্যাসিক মোটরসাইকেল ছাড়াও তারা অফ-রোড, ও অ্যাডভেঞ্চার ধরনের মোটরসাইকেল তৈরি করে থাকে। পৃথিবীর সবথেকে পুরনো মোটরসাইকেল ব্র্যান্ডের একটি রয়্যাল এনফিল্ড। রয়্যাল এনফিল্ডের এই জনপ্রিয়তা একদিনে তৈরি হয়নি। এর পিছনে আছে দীর্ঘ ইতিহাস।
ইন্ডিয়ান ব্র্যান্ড হিসেবে রয়্যাল এনফিল্ড আমাদের কাছে পরিচিত হলেও এর শুরুটা ভারতে নয়। রয়্যাল এনফিল্ডের যাত্রা শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডে। ‘টাউনসেন্ড অ্যান্ড ইকোসাইস’ নাম নিয়ে সর্বপ্রথম বাইসাইকেল তৈরির মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের শুরু। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইংল্যান্ডের রেডিচ শহরের বাসিন্দা জর্জ টাউনসেন্ড। পরবর্তীতে তার ছেলের হাত ধরেই এই প্রতিষ্ঠান এগিয়ে যেতে শুরু করে। এসবই উনিশ শতকের শেষ দিকের কথা। ১৮৯৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই যাত্রা শুরু ‘দ্য এনফিল্ড সাইকেল কোম্পানি লিমিটেড’ – এর। বিশ শতকের শুরুতে তারা মোটরস্পোর্টসের দিকে দৃষ্টি দিতে শুরু করে এবং তারই ধারাবাহিকতায় ১৯০১ সালে নিয়ে আসে তাদের প্রথম মোটরসাইকেল।
তারা শুরু থেকেই টেকসই শক্তপোক্ত মটরসাইকেল তৈরীর ব্যাপারে ছিলেন বদ্ধপরিকর। রয়্যাল এনফিল্ড এর প্রথম লোগোতে ছিলো কামানের ছবি এবং তাদের কম্পানি ট্যাগ লাইন Made Like A Gun।
তবে রয়েল এনফিল্ডকে সাফল্য এনে দিয়েছিল ১৯০৯ সালে তৈরি তাদের ভি টুইন ২৯৭ সিসি ইঞ্জিনের মোটরসাইকেল। এই মোটরসাইকেলের কাঠামো ছিল আলাদা, ইঞ্জিনও ছিল বেশ শক্তিশালী।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তারা ব্রিটেন, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইম্পেরিয়াল রাশিয়ান আর্মির কাছে মোটরসাইকেল বিক্রি করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত নতুন ৮ ধরনের মোটরবাইক তারা বাজারে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে মোটরবাইক তৈরির ব্যাপারে তারা সুনাম অর্জন করতে শুরু করে। রয়্যাল এনফিল্ডের সবথেকে জনপ্রিয় মডেল রয়্যাল এনফিল্ড বুলেট-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৩১ সালে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার রয়্যাল এনফিল্ডের সঙ্গে চুক্তি করে। এবার এই কোম্পানি মিলিটারি গ্রেড মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করে। এ সময় তারা ২৫০ সিসি, ৩৫০ সিসি এবং ৫৭০ সিসি ইঞ্জিনের মোটরসাইকেল তৈরি করে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয় Royal Enfield WD/RE মডেলটি। এটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল প্লেন থেকে প্যারাস্যুটের মাধ্যমে নিচে ফেলার জন্য। যুদ্ধের পরে এটি র একটি সিভিলিয়ান ভার্সন ও মার্কেটে ছাড়ে রয়্যাল এনফিল্ড । এটির নাম দেওয়া হয় Royal Enfield RE125।
১৯৫১ – ১৯৫৩ সালের মধ্যে এর আরো দুটি সংস্করন বাজারে ছাড়া হয়েছিলো। বন্দুকের মতো তৈরি বাইকগুলো তাদের শক্ত কাঠামো এবং অনেক দূর যেতে পারার কারণে সেনাবাহিনীর কাছে খুব জনপ্রিয় ছিল।
ভারতে রয়্যাল এনফিল্ডের প্রবেশ ঘটে ১৯৪৯ সালে। ১৯৪৯ সালেই ৩৫০ সিসির বুলেট প্রথম ভারতের বাজারে আসে। ভারত সরকার এমন এক মোটরসাইকেলের সন্ধানে ছিল, যেটি সীমান্তে টহল দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে পারে। রয়েল এনফিল্ডের বুলেট ৩৫০ ছিল একেবারে মনমতো। ভারতীয় সেনাবাহিনী এটি ৮০০ ইউনিটের অর্ডার দেয়। ১৯৫৫ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি রয়েল এনফিল্ড মাদ্রাজ মোটরসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে চেন্নাইতে একটি সংযোজন কারখানা স্থাপন করে। তাদের চুক্তি অনুসারে মাদ্রাজ মোটরস – কোম্পানির বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক হয় (৫০% এর বেশি)। ১৯৫৭ সালে টুলিং ইকুইপমেন্টও এনফিল্ড ইন্ডিয়ার কাছে বিক্রি করা হয়েছিল যাতে তারা যন্ত্রাংশ তৈরি করতে পারে এবং পূর্ণ উৎপাদন শুরু করতে পারে। প্রথম দিকে শুধু মোটরবাইক অ্যাসেম্বলিং করা হতো ভারতে। তবে ১৯৬২ সালের পর থেকে ভারতেই তৈরি হয় রয়্যাল এনফিল্ড। এনফিল্ড ইন্ডিয়ার মালিকানা এরপর অনেকবার হাতবদল হয়ে বর্তমান মালিক এইচার মটরসের কাছে চলে আসে ১৯৯৪ সালে। তারাই এই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘রয়্যাল এনফিল্ড মোটরস লিমিটেড’। বর্তমানে সারা বিশ্বে ৫০টির বেশি দেশে বাইক বিক্রি করছে রয়্যাল এনফিল্ড।
রয়্যাল এনফিল্ড দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে আসছে। তাই এর আলাদা একটি ভক্তগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এটি পৃথিবীর অন্যতম পুরনো মোটরবাইক ব্র্যান্ড, যা এমনকি বিশ্বখ্যাত হার্লে ডেভিডসন থেকেও পুরনো। ক্ল্যাসিক ধরনের পুরনো ডিজাইন, আলাদা স্টাইল, নজরকাড়া লুক সব মিলিয়েই Royal Enfield হয়ে উঠেছে কাল্ট ক্ল্যাসিক এক মোটরবাইক ব্র্যান্ড। রয়্যাল এনফিল্ডের জনপ্রিয়তার আরও একটি বড় কারণ তাদের প্রতিটি বাইকেই নানা ধরনের কাস্টমাইজেশন বা মড করা সম্ভব। অর্থাৎ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে বাইকের পুরো চেহারাই নিজের মতো করে পাল্টে ফেলা সম্ভব। রয়্যাল এনফিল্ড কাস্টমাইজেশনের ব্যাপারে চালকদের উৎসাহিত করে। বিভিন্ন সিনেমায় রয়্যাল এনফিল্ড মোটরসাইকেলের ব্যবহার এর জনপ্রিয়তাকে আরো অনেক বাড়িয়েছে।
মার্কিন অভিনেতা ব্রাড পিটের অস্কারজয়ী সিনেমা ‘দ্য কিউরিয়াস কেস অব বেনঞ্জামিন বাটন’ দেখে থাকবেন। সেখানে তরুণ ব্রাড পিট যে মোটরসাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, সেটি ছিল রয়েল এনফিল্ড ব্রান্ডের মোটরসাইকেল। সিনেমায় ভারতের বারানসির রাস্তায় এই মোটরসাইকেলে চালিয়ে ঘুরেছেন ব্রাড পিট।
ভারতীয় সিনেমায় বেশিরভাগ আর্মি/পুলিশ অফিসারকেই দেখবেন রয়্যাল এনফিল্ড চালাতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে শুধু সিনেমায় নয় বাস্তব জীবনেও অনেক অভিনেতা অভিনেত্রীদের কাছে রয়েছে রয়্যাল এনফিল্ড এর বাইক। এর ঐতিহাসিক ভ্যালু থাকায় – এটি শুধু একটি মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড হিসেবে আর নেই এটি পরিণত হয়েছে কালেক্টেবল আইটেম এ। ইন্টারনেট দুনিয়ায় বহু গ্রুপ এর সন্ধান পাওয়া যায় যারা রয়্যাল এনফিল্ড এর ক্লাসিক মডেলগুলো রিস্টোরেশন করেন এবং নিজেদের সংগ্রহে রাখার জন্য কালেক্ট করেন ।