Close
ফিচার

বোম্বে ব্লাড – পৃথিবীর বিরল রক্তের গ্রুপ

বোম্বে ব্লাড – পৃথিবীর বিরল রক্তের গ্রুপ

২০ শে মে ২০১৬ , পেশাগত কাজে বের হয়ে সড়ক দূর্ঘটনায় আহত হন মোঃ কামরুজ্জামান । কোমড় ও হাত পায়ের হাড় ভাঙ্গা অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে।রক্তের প্রয়োজন পরলে “o+” রক্তের ব্যাবস্থা করা হয়।মোঃ কামরুজ্জমান ও তার পরিবারের লোক জানতেন তার রক্তের গ্রুপ “o+”।কিন্তু বারবার ক্রস ম্যাচিং করলেও তার শরীরের রক্তের সাথে ক্রস ম্যাচ মিলছিলো না । পরে পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে জানা যায় মোঃ কামরুজ্জামান বিরল রক্তের গ্রুপ “বোম্বে ব্লাড গ্রুপ” এর বাহক।বোম্বে ব্লাড গ্রুপ কে বলা হয় “HH” গ্রুপ।

আমাদের পরিচিত (ABO) ৮টি রক্তের গ্রুপে কোনো না কোনো এন্টিজেন থাকেই। রক্ত গ্রুপগুলোর নামকরণ করা হয় এন্টিজেন এবং এন্টিবডির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির উপর নির্ভর করে। আর H এন্টিজেনকে বলা হয় Precursor এন্টিজেন। এটাকে বিল্ডিং ব্লক অব এন্টিজেনও বলা হয় কারণ সাধারণত ABO সিস্টেমে রক্তের সকল (A+, A-, B, B, AB, AB, O+, O) গ্রুপে H এন্টিজেন উপস্থিত থাকে।

কিন্তু বিরল বোম্বে ব্লাড গ্রুপে এই কমন H এন্টিজেন থাকে না, থাকে H এর এন্টিবডি। এটা একটা বিরল ঘটনাও বটে! O গ্রুপের সাথে বোম্বে গ্রুপের পার্থক্য হলো বোম্বে গ্রুপে H এন্টিজেনও থাকে না।

নামকরণ ও আবিষ্কার :

১৯৫২ সালে “The Lancet’ নামক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক গবেষণাপত্রে সর্বপ্রথম এই বোম্বে রক্তের সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয় (পৃষ্ঠা: ৯০৩-৯০৪, ৩রা মে, ১৯৫২)। গবেষণাপত্রে বোম্বে রক্তের উপর ক্ষুদ্র এই আর্টিক্যালটি লিখেছিলেন ডা. উয়াই.এম. ভেন্ডে, ডা. সি.কে. দেশপান্ডে ও ডা. এইচ. এম. ভাটিয়া। গবেষণাপত্রে বলা হয়, কোনো একদিন (ভারতে) এক রেলওয়ে কর্মকর্তা ও এক ছুরিকাহত ব্যক্তিদ্বয়ের জন্য রক্তের প্রয়োজন হলে, রক্তদাতাদের সাথে ক্রস ম্যাচিং করতে গেলে দেখা যায় যে, কারো রক্তের সাথেই মিলছে না তাদের রক্ত। গবেষণাপত্রের তিন লেখক মিলে ১৬০ জনের মতো মানুষের রক্ত পরীক্ষা করেন, অবশেষে বোম্বের একজন স্থানীয় ব্যক্তির সাথে ক্রস ম্যাচ হয় সেই রক্তের। এই রক্তকে প্রথম বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) শনাক্ত করায় ডা. ভেন্ডে এর নাম দেন বোম্বে ব্লাড। বিজ্ঞানের ভাষায় অবশ্য একে ডাকা হয় “HH” অথবা “OH” গ্রুপের রক্ত বলে। এই রক্তের গ্রুপ এতই অপ্রতুল যে ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে(১২০ কোটি) এই রক্তের গ্রুপ এর বাহক মাত্র ৪০০ জন । সারা পৃথিবীতে প্রতি ১০ লাখ লোকের মাঝে ৪ জন “HH” ব্লাড পাওয়া যায়।মুম্বাই শহরে এই সংখ্যা প্রতি ১০ হাজারে ১ জন। পৃথিবীর মাত্র ০.০০০৪% মানুষের এই গ্রুপের রক্ত রয়েছে। বোম্বে ব্লাড গ্রুপের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হলো, এর বাহকরা একই গ্রুপ ছাড়া কাউকে রক্ত দিতে পারবেনা; অন্য গ্রুপের রক্ত নিতেও পারবেনা।

ব্যতিক্রমী এই গ্রুপ সাধারণ স্লাইডে রিএজেন্ট দিয়ে টেস্ট করলে ফলাফল ‘O’ গ্রুপের মনে হবে। কারণ আমরা ৩ ফোঁটা রক্ত নিয়ে যে টেস্ট করি এখানে H এন্টিজেন চেক করা হয় না। ল্যাবে এডভান্স টেস্ট ছাড়া এই বিরল গ্রুপ নির্ণয় করা সম্ভব না। যাদের রক্তের গ্রুপ ‘O’ (হোক পজিটিভ কিংবা নেগেটিভ) তাদের সবারই একবার “বোম্বে” গ্রুপ বা “HH” group টেস্ট করা দরকার। আপনি আসলেই ‘O’ গ্রুপের নাকি বোম্বে ব্লাড গ্রুপের তা সুনিশ্চিত না হলে হঠাৎ প্রয়োজনে না জেনে ভালোভাবে ক্রসম্যাচ ছাড়া রক্ত গ্রহণ করলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে!

মোঃ কামরুজ্জমানকে রক্তের জন্য মরতে হয় নি । তিনি যে প্রতিষ্ঠান এ কাজ করতেন তাদের সহযোগিতায় রক্ত এসেছিলো ভারত থেকে । সহমর্মিতার নিদর্শন রেখে মোঃ কামরুজ্জমান এর জন্য রক্ত দিয়েছিলেন ৪ জন ভারতীয় ।

কিন্তু লক্ষীপুরের রায়পুরের গৃহিণী মিনু এতোটা ভাগ্যবতী ছিলেন না । অপারেশনের জন্য তার রক্তের প্রয়োজন।পরিবার জানতেন তার রক্তের গ্রুপ ‘O’ পজিটিভ। রক্ত দেওয়ার আগেও পরীক্ষায় জানা যায়, তার রক্তের গ্রুপ ‘O’ পজিটিভ।অপারেশনের সময় তাকে দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। পরে আরেক ব্যাগ রক্ত দেওয়ার সময় জানা যায় ডোনারের সাথে রক্তের গ্রুপ মিলছে না। মিনুর দেহে এই বিরল রক্তের সন্ধান মিললেও অবশ্য তার পরিণতি হয় করুণ। অপারেশনের সময় ‘বোম্বে’ গ্রুপের রক্তের পরিবর্তে ‘O’ পজিটিভ রক্ত দেওয়ায় মিনুর কিডনি বিকল হয়ে যায়। পরে তাকে বিএসএমএমইউ এর আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। মিনুর কিডনি ডায়ালাইসিস করার জন্য বোম্বে গ্রুপের রক্ত প্রয়োজন। তার পরিবারের সদস্যরা ফেসুবকে বিভিন্ন পেজে বোম্বে গ্রুপের রক্ত চেয়ে আবেদন জানায়। ফেসবুকে বোম্বে গ্রুপের রক্ত চেয়ে সাহায্যের পোস্টটি ছড়িয়ে পরার পর বোম্বে গ্রুপের দুজন রক্তদাতা দুই ব্যাগ রক্ত দান করেছিলো মিনুকে। তবে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি তাকে, সোমবার বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে ‘বোম্বে’ গ্রুপের রক্ত শনাক্ত করা হয়। এখন পর্যন্ত ৩০ জনের বেশি মানুষের দেহে বোম্বে গ্রুপের রক্ত শনাক্ত করেছে বিএসএমএমইউ। বোম্বে গ্রুপ নির্ণয়ের কেমিক্যালের দাম বেশি। ৬ মাস পর পর কেমিক্যালের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এই গ্রুপের মানুষ সচরচর পাওয়া যায় না তাই এ কেমিক্যাল সব হাসপাতালে থাকেনা। বিএসএমএমইউ যেহেতু ইউনিভার্সিটি তাই সেখানে এ কেমিক্যাল রেগুলার কেনা হয়। তাই যখন কোন ব্লাড গ্রুপকে বোম্বে বলে সন্দেহ করা হয় তখন তার রক্ত বিএসএমএমইউতে পাঠানো হয়। বোম্বে ব্লাড গ্রুপের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হলো, এর বাহকরা একই গ্রুপ ছাড়া কাউকে রক্ত দিতে পারবেনা; অন্য গ্রুপের রক্ত নিতেও পারবেনা।

বাংলাদেশে এই রেয়ার গ্রুপের রক্তের ডেটাবেইজ দ্রুত তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে সন্তান জন্মদান, দুর্ঘটনাসহ কোন ইমার্জেন্সি পরিস্থিতিতে এই গ্রুপের মানুষের সাথে যোগাযোগ করলে তারা রক্ত দিতে পারেন।” এছাড়া ‘O ‘নেগেটিভ ও বোম্বের মত বিরল গ্রুপের রক্ত প্রক্রিয়াজাত করে সাত বছরের জন্য সংরক্ষণ করা যায়। সে উদ্যোগ ও অতিসত্তর নেওয়া প্রয়োজন। ভারতে প্রতিবছর বোম্বে ব্লাড গ্রুপধারী সবাইকে নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করা হয়। যাতে সবার সাথে সবার সবসময় যোগাযোগ থাকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *