Close
ইতিহাস বিজ্ঞান

রেডিও আবিষ্কার এবং নিকোলা টেসলা-মার্কনী পেটেন্ট যুদ্ধ

রেডিও আবিষ্কার এবং নিকোলা টেসলা-মার্কনী পেটেন্ট যুদ্ধ

সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন একজন মানুষ তার নাম নিকোলা টেসলা(Nikola Tesla)।এই এগিয়ে থাকার ভুক্তভোগীও তিনি।কারণ, তার অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারের গুরত্ব তখনকার মানুষ বুঝতেই পারেনি।

১৮৮২ সালে টেসলা টমাস আলভা এডিসনের কোম্পানির ফ্রান্স অফিসে কাজ করার সুযোগ পান। তাঁর কাজ ছিল বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির নকশা ও উন্নয়ন ঘটানো। দুই বছর পরে কোম্পানির সদর দপ্তরে নিউইয়র্কে ডাক পান। সেখানে তাঁর কাজ করার সুযোগ হয় টমাস আলভা এডিসনের তত্ত্বাবধানে এবং সূচিত হয় এডিসন-টেসলা বিখ্যাত ঝগড়ার!

সেখানে টেসলা দাবি করেন, তিনি এডিসনের জেনারেটর (ডিসি বিদ্যুৎ, ডায়নামো) ও মোটরের উন্নতি করতে পারবেন, যা কিনা সেগুলোর দক্ষতা যেমন বাড়াবে তেমনি কোম্পানিকে লাভজনক করবে। প্রস্তাব শুনে এডিসন রাজি হন। সফল হলে টেসলাকে ৫০ হাজার ডলার দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু সফল হওয়ার পর এডিসন টাকা দিতে অস্বীকার করেন, ‘তুমি আসলে আমেরিকান কৌতুক বুঝতে পারোনি।’ অভিমানী টেসলা তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগ করে এডিসনের কোম্পানি থেকে বের হয়ে আসেন।

উদ্ভাবনের সোনালি দিন:

এডিসনের কোম্পানি থেকে বের হয়ে আসার পর তিনি সেই সময়কার কয়েকজন ধনাঢ্য ও উদ্যোগী ব্যক্তির সহায়তা পান। তাঁদের অর্থানুকূল্যে তিনি ম্যানহাটনে নিজের ল্যাবরেটরি তৈরি করেন। সেখানেই তাঁর উদ্ভাবিত ইন্ডাকশন মোটরের উন্নতি করেন এবং এর মাধ্যমে উদ্ভাবন করেন এসি বিদ্যুৎ তারিত যন্ত্র বা অল্টারনেটর। তাঁর মোটরের কোনো কমিউটেটর না থাকায় সেটিতে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হতো না। ১৮৯৮ সালে তিনি এর পেটেন্ট পান। সে বছরেই ইলেকট্রিক্যাল ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন-এর সম্পাদক টেসলার যন্ত্রপাতি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। এর মাধ্যমে পণ্ডিত মহল এবং ব্যবসায়িক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন নিকোলা টেসলা। জর্জ ওয়েস্টিংহাউসের কোম্পানি এককালীন ৬০ হাজার ডলার এবং প্রতি অশ্বশক্তির জন্য আড়াই ডলার রয়্যালটি দিতে সম্মত হয়। তা ছাড়া তারা তাঁকে মাসে দুই হাজার ডলারের বেতনে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়। ওয়েস্টিংহাউসে থাকার সময় টেসলা একই সঙ্গে ধনবান হন এবং তাঁর নানান উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগান। তাঁর শক্তিতে বলীয়ান ওয়েস্টিংহাউস চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এডিসনের কোম্পানিকে হারিয়ে বৈদ্যুতিক বিতরণ ব্যবস্থায় ডিসির পরিবর্তে এসিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়।

৩০ জুলাই ১৮৯১ সালে টেসলা আমেরিকার নাগরিকত্ব অর্জন করেন। ১৮৯৪ সালে নিজ ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় তিনি একটি তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সন্ধান পান। এখন আমরা জানি সেটি ছিল, সেটা ছিলো এক্স-রে। কিন্তু ১৮৯৫ সালে তাঁর ল্যাবরেটরিতে আগুন লাগলে এর প্রমাণাদিসহ তাঁর মডেল, প্ল্যান, নোট ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ১৮৯৬ সালে উইলহেম রন্টজেন্ট এক্স-রে আবিষ্কারের কৃতিত্ব পেয়ে যান। এ আবিষ্কারের খবর শুনে টেসলা তাঁর নিজের মতো করে এক্স-রে মেশিন তৈরি করেন। সেই সময় তিনি লক্ষ করেন, এক্স-রে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে।

Nikola Tesla(নিকোলা টেসলা) in his lab.

১৮৯১ সাল থেকেই তিনি বেতারতরঙ্গের মাধ্যমে ট্রান্সমিশন নিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছিলেন। ১৮৯১ সালেই বিনা তারে শক্তি স্থানান্তরের কয়েকটি পরীক্ষাও তিনি করে দেখান। ১৮৯৮ সালে টেসলা বেতার তরঙ্গনির্ভর রিমোট কন্ট্রোলার তৈরি করেন এবং তা দিয়ে দূর থেকে একটি নৌকা চালান। তাঁর এ কাজ বেশির ভাগ লোকই ম্যাজিক, টেলিপ্যাথি মনে করে। অনেকেই মনে করে, টেসলা একটি বানরকে দিয়ে এ কাজ করেন!

অন্য দিকে, ১৯০০ সালের ১০ নভেম্বর মার্কনী আমেরিকাতে পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন কিন্তু নিকোলা টেসলা-র আগে করা পেটেন্টের কারণে তাঁর আবেদন খারিজ হয়ে যায়। মার্কনীও দমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি সামনের তিন বছর পেটেন্ট পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যান। অবশেষে জেপি মর্গানের সাহায্যে তিনি ১৯০৪ সালে পেটেন্ট পান। তবে মার্কনীও নতুন কিছু করেছিলেন। তিনি ১৯০১ সালের ১২ ডিসেম্বর “S”অক্ষরকে আটলান্টিকের এক পার অর্থাৎ কর্নউইল, ইংল্যান্ড থেকে অন্য পারে কানাডার নিউ ফাউন্ড ল্যান্ডে পাঠাতে সক্ষম হন। টেসলা যখন এই আবিষ্কার সম্পর্কে জানতে পারেন তখন তিনি বলেন “Marconi is a good fellow, let him continue, he is using seventeen of my patents” যদিও টেসলা বিষয়টা এত সহজ ভাবে নিয়েছিলেন কিন্তু বিষয়টা কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। (এর বিস্তারিত নিচে)

১৮৯৯ সালে টেসলা কলোরাডোতে চলে যান। সেখানে তিনি প্রথম বায়ুমণ্ডলের বিদ্যুৎ কে মানুষের কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। তাঁর ধারণা ছিল, বজ্রপাতের শক্তিকে যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে বিদ্যুৎ সমস্যার একটা ভালো সমাধান হয়। এ জন্য তিনি কৃত্রিম বজ্রপাতের সৃষ্টি করেন। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁর ‘আকাশের বিদ্যুৎ’কে বাড়িতে আনার প্রচেষ্টা সফল হয়নি।

Nikola Tesla(নিকোলা টেসলা) made that towen to capture power from thunder storm.


১৯১৭ সালে টেসলা প্রস্তাব করেন বিদ্যুৎতরঙ্গের মাধ্যমে সমুদ্রের মধ্যে সাবমেরিনের অবস্থান নির্ণয় করা যাবে। দুর্ভাগ্যক্রমে সে সময় মার্কিন নৌবাহিনীর গবেষণা প্রধান ছিলেন টমাস আলভা এডিসন। তিনি ‘এটি কোনো কাজে লাগবে না’বলে নাকচ করে দেন। ১৯৩০-এর দশকে এমিলি গিয়ারডিউ একই নীতিতে রাডার (RADAR) উদ্ভাবন করেন। ১৯২৮ সালে টেসলা তাঁর শেষ পেটেন্টটি পান। সেটি ছিল একটি উড়োজাহাজের, যা খাড়াভাবে উড্ডয়ন করতে পারত। বলা যায়, এটি ছিল প্রথম হেলিকপ্টারের ধারণা।

Nikola tesla(নিকোলা টেসলা) last patent.
US patent no. 1,655,114 for an apparatus for aerial transport.

মার্কনীর সাথে মামলা তখনো চলছিলো।অবশেষ ১৯৪৩ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট টেসলার পক্ষে রায় দেয়। কোর্ট টেসলার পক্ষে বলে :

“Tesla, who was then preoccupied with the wireless transmission of power for use in lighting or for the operation of dynamos, proposed, in a lecture . . . the use of . . . wireless transmission of signals.

The Tesla patent No. 645,576, applied for September 2, 1897 and allowed March 20, 1900, disclosed a four-circuit system, having two circuits each at transmitter and receiver, and recommended that all four circuits be tuned to the same frequency. Tesla’s apparatus . . . could, without change, be used for wireless communication, which is dependent upon the transmission of electrical energy.”

এবং মার্কনির কাজের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বলে
“Reputation, however well-deserved, does not entitle him to a patent for every later improvement which he claims in the radio field. Patent cases, like others, must be decided not by weighing the reputations of the litigations, but by careful study of the merits of their respective contentions and proofs.”


নিকোলা টেসলা তাঁর কাজের স্বীকৃতি তিনি নিজে দেখে যেতে পারেন নি। বিভিন্ন পেটেন্টের কারণে টেসলা অনেক টাকাপয়সা পেলেও তার সবটুকু গবেষণায় ব্যবহার করতেন। ফলে শেষ দিকে দারুণ অর্থকষ্টে পড়ে যান। ১৯৩৪ সাল থেকে ওয়েস্টিংহাউস তাঁকে মাসে ১২৫ ডলার দেওয়া শুরু করে এবং তাঁর হোটেলে থাকার বিল দিয়ে দেয়। নিউইয়র্কার হোটেলের ৩৩২৭ নম্বর কক্ষে ১৯৪৩ সালের ৭ জানুয়ারি নিকোলা টেসলা মারা যান।

নিকোলা টেসলা মোট ৩০০টি পেটেন্টের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে লোকে খুব কম জানে। বিজ্ঞানী মহল ১৯৬০ সালে চৌম্বক ক্ষেত্রের এককের নাম রাখে তাঁর নামে, ‘টেসলা’ হিসেবে ।


একবার আইনস্টাইন কে জিজ্ঞাসা করা হল “পৃথিবীর সব থেকে বুদ্ধিমান ব্যক্তি হতে কেমন লাগে?” আইনস্টাইন উত্তরে বলেছিল “আমি জানি না, এর উত্তর জানার জন্য নিকোলা টেসলাকে প্রশ্নটা করতে হবে”।

সূত্র:

War of Currents | List of Nikola Tesla Patents | EDN
Listverse | Tesla Society | Who Invented Radio

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *