অশ্বত্থামা হত ইতি গজ – কথাটি কোথা থেকে এলো? প্রবাদটির উৎপত্তি, ইতিহাস ও তাৎপর্য

বাংলা ভাষায় আমরা প্রায়ই শুনি একটি প্রবাদ – “অশ্বত্থামা হত ইতি গজ”। কোনো ঘটনার সত্যকে আংশিকভাবে লুকিয়ে বা দ্ব্যর্থবোধকভাবে প্রকাশ করার জন্য এই প্রবচন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এটি কোথা থেকে এলো? এর পেছনে রয়েছে মহাভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেখানে কৌশল, নীতি ও মানবিক দ্বন্দ্ব মিলেমিশে তৈরি হয়েছিল ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্ত।

মহাভারতের প্রেক্ষাপট

মূল শ্লোকটি ছিল-

अश्वत्थामा हत: इति तरो वो कुंजरो वा

(উচ্চারণ – অশ্বত্থামা হতঃ ইতি নর বা কুঞ্জর বা)

অর্থাৎ, অশ্বত্থামা আর নেই, তবে সে মানুষ নাকি হাতি তা বলতে পারব না। 

মহাভারতের বহুল প্রচলিত বা প্রচারিত শ্লোকগুলোর ভেতর এটি অন্যতম। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে লিখিত এ বই সর্বযুগেই ছিল যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এবং গুণে-মানে অসামান্য। মূল মহাভারত সংস্কৃতে লেখা হলেও মোটামুটি ভারতের প্রধান প্রধান আঞ্চলিক ভাষায় এর অনুবাদ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে মহাভারত এবং এর কাহিনী সর্বভারতীয় কৃষ্টি বা লোকজ সাহিত্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞ ব্যাসমুনি মহাভারতকে অনেকগুলো পর্বে ভাগ করেছেন। পর্বগুলোর মধ্যে দ্রোণ পর্বে পূর্বোক্ত শ্লোকটির উল্লেখ করা হয়েছে। 

দ্রোণাচার্যের পটভূমি

গুরু দ্রোণাচার্য ছিলেন ভরদ্বাজ মুনির পুত্র, কৌরব-পাণ্ডব উভয়ের শিক্ষক এবং অশ্বত্থামার পিতা। ব্রাহ্মণ হয়েও তিনি ক্ষত্রিয়ের মতো জীবনযাপন করেন এবং পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা অর্জন করেন। মহারণ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র যোদ্ধা, যার কাছে একসাথে দিব্যাস্ত্র ও ব্রহ্মাস্ত্র ছিল।

দ্রোণাচার্যের পুত্রের নাম অশ্বত্থামা। শিবের বরপ্রাপ্ত দ্রোণাচার্য ভগবান শিবকে তুষ্ট করে এমন পুত্রের বর লাভ করেন, যে হবে শিবের ন্যায় মহাশক্তিধর। অশ্বত্থামা জন্মের পর অশ্বের ডাকের মতো হ্রেষাধ্বনিতে ক্রন্দন করায় শিশুটির নামকরণ করা হয়েছিল অশ্বত্থামা। জন্ম থেকেই কপালে একটি মণি ছিল, যা তাকে অসাধারণ শক্তি ও সুরক্ষা দিত। গুরু দ্রোণ প্রিয়পুত্রকে কৌরব-পাণ্ডবদের সাথে শিক্ষিত করতে থাকেন। অশ্বত্থামার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দুর্যোধনের সাথে।

যুদ্ধ শুরু হলে পুত্রের কারণে দ্রোণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও কৌরবপক্ষে যোগ দেন। বড় বড় রথী-মহারথীরা স্ব স্ব পক্ষে যুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়েন। রাজ্যোদ্ধারের যুদ্ধ পরিণত হয় ধর্মযুদ্ধে। শ্রীকৃষ্ণ অস্ত্র না তুলে পরামর্শ ও হিতোপদেশের মাধ্যমে প্রিয় পার্থ অর্জুন এবং পাণ্ডব শিবিরকে সহায়তা করতে থাকেন। ভীষ্মের পতনের পর দ্রোণাচার্য সেনাপতির পদে অধিষ্ঠিত হন। তার নেতৃত্বে কৌরব সেনা শক্তি ফিরে পায়। রণক্ষেত্রে দিনে দিনে তার রুদ্র রূপ পাণ্ডবদের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ চলছিল তুঙ্গে। কৌরব সেনাপতি দ্রোণাচার্য ছিলেন পান্ডবদের অন্যতম বড় বাধা। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁকে হারানো কার্যত অসম্ভব। কৃষ্ণ বুঝলেন, শক্তি দিয়ে দ্রোণাচার্যকে পরাস্ত করা যাবে না, তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতে হবে।

অশ্বত্থামার নামের কৌশল

দ্রোণাচার্যের পুত্রের নাম ছিল অশ্বত্থামা। ইন্দ্রবর্মার হাতির নাম ও ছিলো অশ্বত্থামা । কৃষ্ণ ভীমকে নির্দেশ দেন— ইন্দ্রবর্মার হাতি অশ্বত্থামাকে বধ করে উচ্চস্বরে ঘোষণা করতে: “অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে!”

ভীম তার গদা দিয়ে হাতি অশ্বত্থামাকে বধ করে মধ্য রণক্ষেত্রে গিয়ে গদা উচিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে ‘অশ্বত্থামাকে আমি এই গদা দিয়ে অশ্বত্থামাকে বধ করেছি’ ‘অশ্বত্থামা আর নেই’ । দ্রোণাচার্য এ সংবাদ শুনে হতভম্ব হয়ে যান। তার বিশ্বাস হয় না। তিনি ভীমকে বলেন, একমাত্র ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের মুখ থেকে শুনলেই বিশ্বাস করব। কারণ যুধিষ্ঠির কখনো মিথ্যা বলে না।

দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরের সম্মুখে এসে জিগ্যেস করেন, ‘পুত্র যুধিষ্ঠির, অশ্বত্থামা কি সত্যি মারা গিয়েছে?’দ্রোণাচার্য দ্রোণ যুধিষ্ঠিরের সম্মুখে এসে জিগ্যেস করেন, ‘পুত্র যুধিষ্ঠির, অশ্বত্থামা কি সত্যি মারা গিয়েছে?’ যুধিষ্ঠির জানতেন আসল সত্য – হাতি মারা গেছে, মানুষ নয়। কিন্তু কৃষ্ণের কৌশল মানতে উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেন,

“অশ্বত্থামা হতঃ ইতি কুঞ্জর।”

ইতি কুঞ্জর(গজ বা হাতি)’ তিনি খুব মৃদুস্বরে বললেন। যাতে দ্রোণাচার্যের কানে না পৌঁছে ফলে দ্রোণ মনে করলেন তাঁর প্রিয় পুত্র মারা গেছে। পুত্রশোকে দ্রোণাচার্য ভেঙে পড়েন। অস্ত্র ত্যাগ করে তপস্যায় বসেন। এই সুযোগে পাঞ্চালদেশের রাজা দ্রুপদের (যজ্ঞসেন) পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে হত্যা করলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল এই ঘটনার মাধ্যমে।

প্রবাদে রূপান্তর

এরপর থেকে “অশ্বত্থামা হতঃ ইতি কুঞ্জর যা বাংলায় এসে অশ্বত্থামা হত ইতি গজ” বাংলাসহ বহু ভাষায় প্রবাদে রূপ নেয়। এর প্রতীকী অর্থ হলো –
👉 আংশিক সত্য বা দ্ব্যর্থবোধক কথা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা।