১৯৮৪ সালে ভোপাল এ ঘটে যাওয়া “ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি” নিয়ে নির্মিত চার পর্বের নেটফ্লিক্স সিরিজ The Railway Men – The Untold Story of Bhopal, 1984। ১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানায় গ্যাস লিক হয়ে মিথাইল আইসোসায়ানেট বাতাসে ছড়িয়ে পরে। এই বিষাক্ত গ্যাস রাতের ধূসর কুয়াশা আর শীতল বাতাসে মিশে মৃত্যুদূত হয়ে নেমে আসে ভোপালবাসীর দুয়ারে। এই বিভীষিকার রাতে প্রাণ হারান ভোপালের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। এখনো ভোপালের লাখো মানুষ এ রাতের ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ভোপালের ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া কারখানা ছিল একটি কিটনাশক উৎপাদন কারখানা। তখনকার বহুল ব্যাবহৃত কিটনাশক “সেভিন” উৎপাদন করা হতো এই প্ল্যান্ট এ। এর জন্য সোডিয়াম আইসোসায়ানেট আমদানি করা হতো ভারত এর বাইরে থেকে কিন্তু কিছুদিন পর এখানে অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে সোডিয়াম আইসোসায়ানেট উৎপাদন ও সংরক্ষণ করা শুরু করা হয়। কিন্তু এটি উৎপাদন ও সংরক্ষণ এর জন্য যে সেইফটির নীতিমালাগুলো অনুসরণ করতে হয় তার কোন তোয়াক্কাই করে নি ইউনিয়ন কার্বাইড৷ কারখানায় অনেক যন্ত্রাংশ ই বিকল হয়ে পড়ে ছিলো। যে কোন সময় বড় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে জেনেও মার্কিন মালিকানাধীন এর প্রতিষ্ঠান এর কর্তাব্যাক্তিরা ছিলেন নির্বিকার। এমন কি কারখানার শ্রমিকদের জন্যও ছিলো অপ্রতুল গ্যাস মাস্ক ও সেফটি ইকুইপমেন্ট এর ব্যবস্থা।
মিথাইল আইসোসায়ানেটের বিষাক্ত থাবা কতটা ভয়ানক ছিলো সে রাতে সেটা আরো ভালোভাবে বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রের অকুপেশনাল সেফটি এন্ড হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য থেকে। তাদের মতে, একটি আট কর্মঘণ্টার কারখানায় মিথাইল আইসোসায়ানেটের নিরাপদ মাত্রা ০.০২ পিপিএম(পার্টস পার মিলিয়ন)। ০.৪ পিপিএমের উপস্থিতিতেই যেখানে কফ, বুকে ব্যথা, অ্যাজমা, ত্বকের ক্ষতি থেকে শুরু করে চোখ, নাক আর গলা জ্বালা-পোড়া করতে পারে, সেখানে ভুপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির মিথাইল আইসোসায়ানেটের পিপিএম ছিল ২৭! যা আদর্শ মানের (০.০২ পিপিএম) তুলনায় প্রায় ১, ৪০০ গুণ বেশি ছিল।
মধ্যরাতে ভোপালের ঘুমন্ত মানুষগুলো আক্রান্ত হয় এই বিভীষিকার। অক্সিজেন এর অভাবে লোকজন বেড়িয়ে আসে ঘরের বাইরে। মানুষজন দিগ্বিদিক শূণ্য হয়ে ছুটতে থাকে। বাইরে অবস্থা ছিলো আরো ভয়ানক । চারপাশ বিষাক্ত গ্যাস এ আচ্ছন্ন। রাস্তাঘাটে লোকজন এই বিষাক্ত গ্যাস নিশ্বাসের সাথে শরীরে গিয়ে রাস্তায় ই মরে পড়ে থাকতে থাকে। ডমিনোস ইফেক্ট এর মতো সারি সারি লাশ পড়ছিল ভোপালের রাস্তায়, বাড়িতে, গাড়িতে, রেলস্টেশনে, সবখানে।
এই চরম বাস্তবতা আর হৃদয় বিদারক এই রাতের ঘটনা ও এই রাতের কিছু সাহসী বীর – যারা নিজের জীবণ বিপন্ন করে বাঁচিয়েছেন আরো হাজারো মানুষের জীবণ তাদের গল্পগাথা নিয়েই “শিব রাওয়াইল” বানিয়েছেন এই সিরিজ।
কিন্তু এই সিরিজের নাম ‘দ্য রেলওয়ে মেন’ কেন? কারণ, সিরিজ়ে জরুরি, বা বলা চলে একদম অপরিহার্য চরিত্র হচ্ছে ভোপাল জংশন এবং তার আশেপাশের কয়েকটি জংশনের রেলকর্মী থেকে শুরু করে রেলমন্ত্রনালয় এর লোকজনও। ভোপাল গ্যাস বিপর্যয়ের পর কী ভাবে রেলকর্মীরা তাঁদের জীবন বাজি রেখে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তারও একটা দলিল এই সিরিজ়। এই বিপর্যয় এর সময় তাদের কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত কিভাবে বাঁচিয়েছে হাজারো মানুষের প্রাণ – তাও উঠে এসেছে এই গল্পে। কাঠামোর দিক থেকে হয়তো এই সিরিজ খানিক অনুপ্রাণিত ২০১৯-এ মুক্তি পাওয়া ‘চের্নোবিল’ মিনি সিরিজ থেকে, যে সিরিজ় সোভিয়েত ইউনিয়নের চের্নোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র-বিপর্যয়ের ওপর তৈরী। চার পর্বের এই সিরিজ দেখতে গিয়ে বার বার দমবন্ধ হয়ে এসেছে। মানুষের যন্ত্রনা – দুঃখ গুলো ফুটে উঠেছে প্রতিটি ফ্রেম এ । ডিটেইলিং ছিলো দূর্দান্ত। কে কে মেনন, বাবিল খান,দিভবেন্দু সহ সব অভিনেতারাই দূর্দান্ত অভিনয় করেছেন৷ সিরিজটি শেষ করার পর ও যেন বুকের ভেতর রয়ে গেছে একরাশ দলা পাকানো যন্ত্রনা – কান্না – হাহাকার। ডিরেক্টর এর সার্থকথা হয়তো এখানেই…
সময় পেলে দেখে নিতে ভুলবেন না এই সিরিজ টি।