ত্রিশঙ্কু অবস্থা – কথাটি কোথা থেকে এলো?
‘ত্রিশঙ্কু অবস্থা’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ অনিশ্চিত অবস্থা। আগেও যেতে পারে না আবার পেছনেও হটে যেতে পারে না এমন অনিশ্চিত অবস্থাকে বাংলায় ত্রিশঙ্কু দশা, ত্রিশঙ্কু অবস্থা কিংবা ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে থাকা বাক্যভঙ্গিতে প্রকাশ করা হয়। ভারতীয় পুরাণে বর্ণিত বিখ্যাত রাজা ত্রিশঙ্কুর অবস্থা থেকে এই বাক্যভঙ্গিটির উৎপত্তি। ভারতীয় পুরাণের এই রাজা স্বর্গে যেতে গিয়ে আকাশ আর পৃথিবীর মাঝখানে আটকে থেকে যান।
ত্রিশঙ্কু(Trishanku) ছিলেন ইক্ষ্বাকু রাজবংশের একজন রাজা। একদিন, ভারতীয় পুরাণের এই রাজা মনস্থির করেন তিনি জীবিত অবস্থায় স্বর্গে যেতে চান। এরপর তিনি সাহায্যের জন্য তাঁর শিক্ষক ঋষি বশিষ্ঠের কাছে যান। ঋষি রাজার এই ইচ্ছা পুরনে সাহায্য করতে অস্বীকার করেন কারণ এটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ছিল। তবে ত্রিশঙ্কু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তখন তিনি বশিষ্ঠের পুত্রদের সাহায্য চাইলেন। ঋষির পুত্ররাও রাজার কথা শুনে ক্রোধান্বিত হলেন এবং তাঁকে সাহায্য করতে অস্বীকার করলেন। যেহেতু তাদের পিতা রাজাকে আগেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাই তারা অনুভব করেছিল যে রাজা তাদের কাছে গিয়ে সাহায্য চেয়ে তাদের পিতাকে অপমান করেছেন। ঋষির পুত্ররা রাজা ত্রিশঙ্কুকে চান্ডাল হওয়ার অভিশাপ দেয়।
অভিশাপ ত্রিশঙ্কুর চেহারায় রূপান্তর ঘটে এবং তাকে আর রাজার মতো দেখায় না। তবুও অবিচল রাজা ত্রিশঙ্কু, তার ইচ্ছা পূরণের জন্য বশিষ্ঠের প্রতিদ্বন্দ্বী ঋষি বিশ্বামিত্রের কাছে যান। রাজার প্রত্যাশা অনুযায়ী, বিশ্বামিত্র দুস্থ রাজাকে সান্ত্বনা দেন এবং তাকে সাহায্য করতে রাজি হন। তিনি তার ছেলেদের ডেকে পাঠালেন এবং তাদের একটি যজ্ঞ পালনের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। তিনি তাঁর শিষ্যদেরকে যজ্ঞ পালন ও বলিদানের জন্য সমস্ত বিদ্বান ঋষিদের তাঁর আশ্রমে আমন্ত্রণ জানাতে আদেশ করেন। কিছু দিন পর, তাঁর শিষ্যরা ফিরে এসে তাঁকে জানায় যে বশিষ্ঠের পুত্র ছাড়া সকলেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।
অবশেষে, যজ্ঞের দিন এসে গেল এবং বিশ্বামিত্র এর প্রধান পুরোহিত হিসাবে দায়িত্ব পালন করলেন। যজ্ঞ সমাপ্ত হওয়ার পর, বিশ্বামিত্র দেবতাদের অনুরোধ করেন তাঁরা যেন নৈবেদ্য গ্রহণ করেন এবং ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গে নিয়ে যায়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরও কোনো দেবদেবীর দেখা মেলেনি। ঋষি রাগান্বিত হলেন। তিনি রাজার দিকে ফিরে ঘোষণা করলেন যে তিনি দেবতাদের সাহায্য ছাড়াই ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গে উঠতে সাহায্য করবেন। বিশ্বামিত্র এই কথাগুলো বলার সাথে সাথে রাজা স্বর্গের দিকে যেতে লাগলেন। যাইহোক, যখন তিনি স্বর্গের দ্বারে পৌঁছালেন, তখন ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতারা তার প্রবেশে বাধা দেন, এই বলে যে রাজা তার শিক্ষকের পুত্রদের দ্বারা অভিশাপিত হয়েছিল। সুতরাং, স্বর্গে তার কোন স্থান থাকতে পারে না। দেবরাজ ইন্দ্রের নেতৃত্বে তাঁরা ত্রিশঙ্কুকে মর্ত্যপথে ঠেলে দেন। বিভ্রান্ত ও হতভম্ব হয়ে ত্রিশঙ্কু নিচে পড়ে যেতে লাগলেন এবং বিশ্বামিত্রকে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করলেন। তার ঐশ্বরিক ক্ষমতা ব্যবহার করে, বিশ্বামিত্র মধ্য-বাতাসে রাজার পতন রোধ করেন।
তিনিও ত্রিশঙ্কুকে পৃথিবীতে নামতে দিলেন না। দেবতাদের একহাত দেখিয়ে দেওয়ার মানসে বিশ্বামিত্র ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গের দিকে ঠেলতে শুরু করলেন। অন্যদিকে ঊর্ধ্বলোক দেবতারা ত্রিশঙ্কুকে মর্ত্যে পাঠানোর জন্য ধাক্কাতে শুরু করলেন। আকাশে সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। বিশ্বামিত্রের তেজও কম নয়। সুতরাং দেবতারা পড়লেন মহা সংকটে। বিশ্বামিত্রের তেজের কাছে দেবতরা অনেকটা বিপন্ন হয়ে পড়েন।
ভীত ও বিপন্ন দেবতাগণ তখন বিশ্বামিত্রের কাছে নিজেদের মান রক্ষার আবেদন জানালেন। এ অবস্থায় বিশ্বামিত্র সিদ্ধান্ত নিলেন, ত্রিশঙ্কু তাহলে আকাশ আর পৃথিবীর মাঝখানে অবস্থান করুক। অতঃপর বিশ্বামিত্র ত্রিশঙ্কুর থাকার জন্য আকাশ আর পৃথিবীর মাঝখানে নতুন এক স্বর্গ – নক্ষত্রলোক সৃষ্টি করে দেন। ভারতীয় পুরাণের এ বিখ্যাত গল্প বাক্যভঙ্গির আশ্রয়ে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে।