Close
মিথোলজি

কুম্ভকর্ণ কে ? বিষ্ণুদেবের পরম ভক্ত থেকে রাবণ ও কুম্ভকর্ণ কী করে রামের শত্রু হলেন!

কুম্ভকর্ণ কে ? বিষ্ণুদেবের পরম ভক্ত থেকে রাবণ ও কুম্ভকর্ণ কী করে রামের শত্রু হলেন!

বাংলা ভাষায় আদিকাল থেকেই অনেক প্রবাদ লোকমুখে ও সাহিত্যে প্রচলিত আছে। এই রকমই একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হল ‘কুম্ভকর্ণের ঘুম’। এই প্রবাদের অর্থ, যে ব্যক্তি মাত্রাতিরিক্ত ঘুমান। সহজে ঘুম ভাঙানো যায় না সেই ব্যক্তির ঘুম কুম্ভকর্ণের ঘুম নামে পরিচিত। এ কারণে কেউ খুব ঘুমকাতুরে হলে তাকে কুম্ভকর্ণ বলে মশকরাও করা হয়।

এই প্রবাদটি বাংলায় এসেছে হিন্দু পুরাণ “রামায়ণ” থেকে। হিন্দু পুরাণ রামায়ণের একটি চরিত্র কুম্ভকর্ণ(Kumbhakarna)। ‘কুম্ভকর্ণের ঘুম’ প্রবাদটির উৎপত্তি রামায়ণের সময়কালেই। রাম-রাবণের যুদ্ধেও কুম্ভকর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়। হিন্দু পুরান সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তাদের কাছেও বহুল প্রচলিত প্রবাদ হিসেবে ‘কুম্ভকর্ণ’ একটি পরিচিত শব্দ । কুম্ভকর্ণের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে কুম্ভ – এর মত কর্ণ অর্থাৎ কলসির মতো কান।

বিরাট দানবাকৃতির চেহারা ও বিকট খাদ্যাভ্যাসের কারণে তিনি যেমন আলোচিত তেমনি চরিত্রবান ও দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। তিনি বছরে ছয় মাস ঘুমিয়ে কাটাতেন। এ কারণে কেউ খুব ঘুমকাতুরে হলে তাকে কুম্ভকর্ণ বলে মশকরাও করা হয়।

A painting of Kumbhakarna(কুম্ভকর্ণ) and Ravana(রাবণ) in battlefield.

কুম্ভকর্ণ ছিলেন বিশ্রবা মুনি ও কৈকেশী-র দ্বিতীয় সন্তান এবং রাক্ষসরাজ রাবণের মেজো ভাই। কুম্ভকর্ণ ছিলেন আকার ও আয়তনে বিশাল বড়, সাথে তাঁর ক্ষুধার পরিমাণও ছিল বিশাল মাপের। জন্মের পরেই ক্ষুধা নিবারণের জন্য কুম্ভকর্ণ রাজ্যের প্রায় সহস্র প্রজাদের ভক্ষণ করেছিলেন। শক্তিশালী কুম্ভকর্ণের পর্বতপ্রমাণ খিদে নগরবাসীদের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এদিকে খাদ্যবস্তুর পাশাপাশি মানুষ, পশু সমস্ত কিছু খেতে শুরু করে কুম্ভকর্ণ।  দেবরাজ ইন্দ্র কুম্ভকর্ণের নানা কান্ডে অস্থির হয়ে একবার তাকে ব্রজের আঘাত করেছিলেন। কুম্ভকর্ণ ছিলেন মহাবলশালী ও দৈত্য আকৃতির। কিছু সময় পর মহাবলশালী কুম্ভকর্ণ ও তার ভ্রাতাদ্বয় অমরত্ব লাভ করার জন্য গোকর্ণ আশ্রমে গিয়ে ব্রহ্মাদেবের তপস্যা শুরু করেন। তারা এই মহাযজ্ঞে অংশগ্রহণ করে প্রজাপতি ব্রহ্মাকে তুষ্ট করতে সফল ও হন৷ কুম্ভকর্ণ চেয়েছিলেন দেবরাজ ইন্দ্রের আসন ছিনিয়ে নিতে ব্রহ্মার কাছে পাওয়া বরের মাধ্যমে। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র তা জানতে পারেন। তাই দেবরাজ ইন্দ্র দেবী সরস্বতীর কাছে এইরূপ অনর্থ যাতে না হয় তার অনুরোধ করেন। ব্রহ্মার কাছে বর চাওয়ার সময় দেবরাজ ইন্দ্রের অনুরোধে দেবী সরস্বতী তার জিহ্বা আড়ষ্ট করে দেন৷ এই কারণে বর হিসাবে ‘ইন্দ্রাসন’ চাওয়ার বদলে তিনি ‘নিদ্রাসন’ চেয়ে বসেন৷ ভগবান ব্রহ্মাও এই শুনে ‘তথাস্তু’ বলেন। ব্রহ্মার বর সঙ্গে সঙ্গে ফলে যায়। মহাবলী কুম্ভকর্ণ সেই মুহূর্তেই নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়েন। অন্য তথ্য থেকে এরকম ও পাওয়া যায় যে তিনি ‘নির্দেবত্বম’ (দেব নির্বাণ) চাওয়ার বদলে ‘নিদ্রাবত্বম’ চেয়ে বসেন৷ ব্রহ্মাও তাঁকে সেই বর দেন। চৈতন্য ফিরে পেয়ে কুম্ভকর্ণ নিজের ভুল বুঝতে পারেন। পরে রাবণ কুম্ভকর্ণের হয়ে ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করলে তিনি কুম্ভকর্ণের ছয় মাস নিদ্রিত থেকে এক দিনের জাগার বর দেন সাথে এটাও বলেন ছয় মাসের আগে কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গ হলে তার নিশ্চিত মৃত্যু হবে। ব্রহ্মার কাছ থেকে শাপরূপ বর পাওয়ার পর কুম্ভকর্ণ ছয় মাস ধরে ঘুমাতেন এবং এক দিন জাগতেন। তার ঘুম ভাঙলে মানুষসহ হাতের সামনে যা পেতেন তা-ই ভক্ষন করতেন বলে জানা যায়৷

A painting of Kumbhakarna(কুম্ভকর্ণ) sleeping & people trying to wake him up for the war.


রাম-রাবণের যুদ্ধে রাবণ কুম্ভকর্ণকে অসময়ে জাগানোর জন্য লক্ষ লক্ষ শঙ্খ , ঢাক বাজানো হয়েছিল তার কানের কাছে । বুকের উপর পাথর , বৃক্ষ ফেলা হয়েছিল । কেউ আবার সারাশি দিয়ে কুম্ভকর্ণের গায়ের মাংস টেনেছিল। কুম্ভকর্ণ ঘুম থেকে ওঠার পর তার বড় ভাই রাবণের কাছে সব শুনে তাঁকে বলেছিলেন, পরস্ত্রী হরণ করে যদিও রাবণ অন্যায় করেছেন, তবু তিনি শত্রুর হাত থেকে রাবণকে রক্ষা করবেন। যুদ্ধে কুম্ভকর্ণের তেজে অনেক বানর সৈন্য হতাহত হয়, অনেক বানর সৈন্যকে আহার করেন কুম্ভকর্ণ। কিন্তু রামের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে কুম্ভকর্ণ নিহত হন। নিহতের সময় তাঁর দেহ যুদ্ধক্ষেত্রে পতিত হলে রামের কয়েক শ সৈন্য পিষ্ট হয়ে মারা যায়।

কিন্তু এই রাবণ এবং তাঁর ভাই কুম্ভকর্ণ আগের জন্মে ছিলেন বিষ্ণুর পরম ভক্ত। পরজন্মে তাঁরাই বিষ্ণুর শত্রু হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। দুরাচারী রাবণের বিনাশ করতেই বিষ্ণুর-অবতার রামকে জন্ম নিতে হয়েছিল ধরায়। এর নেপথ্যে রয়েছে এক করুণ কাহিনি…

বৈকুণ্ঠের দ্বাররক্ষী ছিলেন তাঁরা। নাম ছিল জয় আর বিজয়। বিষ্ণুদেব ও লক্ষ্মীদেবীর আজ্ঞা ভিন্ন তাঁরা কিছুই জানতেন না। একদিন বৈকুণ্ঠে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন বিষ্ণু। তখন লক্ষ্মী এসে জয়-বিজয়কে জানান, প্রভু বিশ্রাম নিচ্ছেন, কেউ যেন এ সময় তাঁকে বিরক্ত না করেন।

তখন দ্বারে প্রহরারত জয়-বিজয়ের কাছে এসে ব্রহ্মার মানসপুত্র চার ঋষি বিষ্ণুর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। জয় ও বিজয় চার ঋষিকুমারকে চিনতে পারেননি। জয় ও বিজয় তাঁদের ঢুকতে বাধা দেওয়ায় ব্রহ্মার মানসপুত্ররা অভিশাপ দেন। সেই অভিশাপ শুনে জয় ও বিজয় কাতর হয়ে পড়েন দুঃখে। অতঃপর বিষ্ণু সব জানতে পারেন। তিনি এসে দেখেন, তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে এসেছেন ব্রহ্মার চার মানসপুত্র সনক, সদানন্দ, সনাতন, সনৎকুমার। এদিকে তাঁদের দ্বারা শাপভ্রষ্ট হয়ে কাঁদছেন জয় ও বিজয়। বিষ্ণু বলেন, ঋষিকুমারদের সেই অভিশাপ খণ্ডনের কোনো উপায় নেই। তাদের রাক্ষসকুলে জন্মাতেই হবে। তবে ঋষিবাক্য খণ্ডন না হলেও তাঁদের শাস্তি কমানো যেতে পারে। এরপর বিষ্ণুদেবের আদেশমতো ঋষিকুমাররা বলেন, দুটি উপায় রয়েছে। হয় তাঁদের সাত জন্ম মর্ত্যে জন্মাতে হবে এবং তারা বিষ্ণুর উপাসক হয়েই থাকবেন। নতুবা তাঁদের তিন জন্ম মর্ত্যে জন্মাতে হবে বিষ্ণুর শত্রুরূপে।

বিষ্ণুর অবতারের হাতে বধ হয়ে তাঁদের মুক্তি ঘটবে। অর্থাৎ পর পর তিন জন্ম তাঁদের বিষ্ণুর শত্রু হতে হবে। বিষ্ণর অবতারের হাতে বধ হলেই মুক্তি। সেইমতো জয় ও বিজয় বেছে নিলেন দ্বিতীয় শর্তটি। ভাগবত পুরাণ অনুসারে তারা পরপর তিন জন্ম তারা নারায়ণের শত্রু রূপে জন্মগ্রহণ করেন। জয় ও বিজয় প্রথম জন্মে হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যক্ষ নামে দু-ভাই হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। বিষ্ণু বরাহ অবতারে হিরণ্যক্ষকে এবং নৃসিংহ অবতার হিসেবে বধ করেছিলেন হিরণ্যকশিপুকে। দ্বিতীয় জন্মে রাবণ ও কুম্ভকর্ণ হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন জয় ও বিজয়। বিষ্ণুর রাম অবতার রূপে মর্ত্যে আসার পর রাবণ ও কুম্ভকর্ণ বধ হন। আর তৃতীয় জন্মে জয় ও বিজয় শিশুপাল ও দন্তবক্র নামে জন্ম নিয়েছিলেন। কৃষ্ণের হাতে তাঁরা দুই ভাই নিহত হন। তারপরই মুক্তিলাভ করেন জয় ও বিজয়। পুনরায় তারা ফিরে যান বিষ্ণুলোকে। বৈকুণ্ঠের দ্বাররক্ষী হিসেবে নিযুক্ত হন। এটাই ছিল বিষ্ণুর পরম ভক্তের শত্রুরূপে অবতীর্ণ হওয়ার কাহিনি।


1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *